শিক্ষা, শিক্ষকতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনা

জ্ঞানের সাথে শিক্ষকতার সম্পর্কটা নিবিড়। আদিকাল থেকে তাই শিক্ষক সম্প্রদায় ছিলেন শ্রদ্ধার স্বর্গ। ইতিহাসে আছে অনেক মহান মহান শিক্ষকের কর্ম ও নীতি সম্ভার। রাষ্ট্র-দর্শন-সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই পাথেয় তাঁরা। তাঁরা ছিলেন বলেই বিকশিত হয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। চর্চার আধুনিক রূপ পাচ্ছি আমরা। অনেকে আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে গেলে তাদের সম্পর্কে অধ্যয়ন আবশ্যক। শিক্ষা একটি মুক্ত বিষয়। এই মুক্ত বিষয়টিকে যখন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা শুরু হলো, আমরাও বাঁধা পড়ে গেলাম। শিক্ষা এখন আর মানবিক উৎকর্ষ সাধনের বস্তু নয় কোন। বরং ভোগের হাতিয়ার মাত্র। এই হাতিয়ারকে ধারালো করতে চাই নামি-দামী প্রতিষ্ঠানের সনদ। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এতটুকুই পাচ্ছি। এর অধিক কিছু দিচ্ছে বলে মনে হয়না। এই মনে হওয়া বিন্দুমাত্র কাল্পনিক নয়। অবশ্যই অভিজ্ঞতা প্রসূত।
যে ক’টা বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছি তার মধ্যে মাঠে-ময়দানের দিনগুলোই ছিলো সবচেয়ে আলোকিত। আর ক্লাসরুমটা অন্ধকার। কারণ ক্লাসরুমে পাঠ দিতে আসতো অনেকেই, কিন্তু শিক্ষকতার যোগ্যতা ছিলোনা অধিকাংশেরই। তাদের শিক্ষা নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য, লেগে থাকা পদোন্নতির জন্য। তারা নিয়োগ পেয়েছেন মন্ত্রী বা এমপির সুপারিশে। চিন্তার পরিধি তাতেই সীমাবদ্ধ। বেশভূষায় একেকটা মাকাল ফল। ক্লাসে শুধু কয়েকটা বইয়ের লাইনই পুনঃপুন আওড়ান। এর বেশি পড়াশুনা বা গবেষণা কোন কিছুই তাদের নেই। কেউ কেউ শেয়ার ব্যবসা নিয়ে দিনরাত পার করছেন। কারণ লক্ষ-কোটি টাকা তাদের এই বাজারে খাটানো। অর্থনীতি বা সমাজতত্ত্ব পড়ান কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলসের একটি বইও তারা পড়ে দেখেননি। কয়েকটি একাডেমিক ও গাইড বই-ই তাদের সম্বল। সেখান থেকেই নিয়মিত আওড়ান। সামজতন্ত্র-কমিউনিজমকে একই মনে করেন। অধিক প্রশ্ন করলে ক্ষেপে যান। অভদ্র ভাবেন। উপস্থিত হারের দোহাই দিয়ে ক্লাস করতে বাধ্য করেন। কারণ তারা জানেন উপস্থিত হার না থাকলে শতকরা দশ জনও তাদের ক্লাসে থাকবেনা। ছাত্ররা যেখানে বসে-খায়-আড্ডা দেয় সেখানটায় যাওয়া অসম্মানের এবং একই বাসে চড়লে তাদের অপমানবোধ হয়। এমন অস্পৃশ্য মনোভাবে নিজেরা-নিজেরাই আপ্লুত হন।
নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য সিজিপিএ পয়েন্ট অর্জন করেছেন। পয়েন্ট অর্জনের জন্য মুখস্ত বিদ্যা। কেবল মুখস্ত বিদ্যাই নয় অনেকের ক্ষেত্রে প্রশাসনের বদান্যতার ব্যাপারটিও শুনতে পাই। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেলো সরকার দলীয় রাজনীতি বা সাংবাদিকতার জোর। সাংবাদিকতার জোর মানে ছাত্র জীবনে সাংবাদিক ছিলেন। প্রশাসনের হয়ে সাংঘাতিক কিছু রিপোর্ট করেছেন। অর্থাৎ আন্দোলন বা প্রয়োজনীয় মুহূর্তগুলোতে কর্তৃপক্ষের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। নিকট অতীতের অধিকাংশ শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে এভাবেই। অসৎ পদ্ধতির এইসব নিয়োগপ্রাপ্তদের দ্বারা সততা শিক্ষা দেয়া কিভাবে সম্ভব! কারণ তারা মনে-মস্তিষ্কে অসৎ, বাকিটা ভান। মহান ও শিক্ষকতা এখন বিপরীত মেরুর শব্দ। তাই বিশ্ববিদ্যালয় এবং জ্ঞান অর্জন পাশাপাশি মানায় না। এরপরও অনেকে পড়তে চায়, শিখতে চায়। যারা প্রকৃতই শিখতে চায় তারা নিজে নিজে শিখে। এবাবে শিখতে বাধ্য হয়। সমাজে প্রকৃত শিক্ষকের আজ বড় অভাব।
এ এক দৈন্য পরিস্থিতি। এমন দৈন্য পরিস্থিতির মধ্য থেকেই প্রতিবছর হাজার-হাজার শিক্ষার্থী যুদ্ধ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচেছ। কেউ কেউ সাক্ষাৎকারের আগে জিজ্ঞেস করে কোন বিষয়টা ভালো। অর্থনীতি না রাজনীতি বিজ্ঞান। দর্শন না ইতিহাস। গণিত না পদার্থবিদ্যা। তার মানে একটি বিষয় ভালো, অপরটি খারাপ। আসলে তারা ভালো মানে বোঝাতে চায় কোনটার বাজার ভালো। কোনটাতে সেশন জট কম। মৌলিক আর এক্সিকিউটিভের সংজ্ঞা তাদের অজানা। ক্লাসরুমগুলোতেও এর শিক্ষা দেয়া হয়না। রাজনীতি বিজ্ঞান পড়েন কিন্তু রাজনীতির সাথে কোন সম্পর্ক নেই তাদের। দর্শন পড়েন সমাজ নিয়ে ভাবেন না। শিক্ষা এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে আজ চর্চা থেকে। শিক্ষক সমাজ কি পারবেন এ দায় এড়াতে? শাসকগোষ্ঠীর লেজুরবৃত্তি তাদেরকে কূপমণ্ডূক করে তুলেছে। সমাজ-ভাবনায় তাই অগ্রসর চিন্তা তাদের দ্বারা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় কনসেপ্টও তাদের কাছে ধোঁয়াশা। ফলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হয়ে উঠেছে ঊর্ধ্বতন-অধস্তনের অনুরূপ। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে তারা জুনিয়র স্কলার-সিনিয়র স্কলার মেনে নিতে পারেন না। এটি তাদের অক্ষমতা। শিক্ষক লেবাসে এরা একেকজন আমলা। জ্ঞান বিকাশের ঠাঁইগুলোতে আসলে আমলাতন্ত্রই কায়েম হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ এদের আশ্রয়স্থল। যা আবার সাম্রাজ্যবাদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা। জাতীয়-গণতান্ত্রিক চিন্তা আশঙ্কাজনকভাবে তাদের মাঝে অনুপস্থিত। সব মিলিয়ে এক বন্ধ্যত্ব পরিস্থিতি। শহীদ শামসুজ্জোহার চেতনা বললে আজ কেবলই ইতিহাস। এই চেতনা বর্তমান শিক্ষক সমাজকে আর আলোড়িত করেনা। শিক্ষা ও ছাত্র সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা একবারেই নগণ্য। কেউ কেউ রাজনীতি করেন ঠিক। কিন্তু সেই রাজনীতি ব্যক্তিগত সুবিধাভোগের রাজনীতি। শাসকশ্রেণীর দুই শিবিরে বিভক্ত তারা। আর একটা অংশ আছে যারা মিডিয়াতে কারাবদ্ধ। নিজস্ব কোন চিন্তা নেই। সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়াই তাদের আশ্রয়স্থল। দালাল মিডিয়া রাজনীতিকে খারাপ আখ্যায়িত করলে তারা তা সঠিক মনে করেন। বিরাজনীতিকরণের চেষ্টায় আরো নিশ্চিন্ত হন। জনগণ ভাবনা তাদের মাঝে দিনে-দিনে লোপ পেয়েছে। এভাবে লুটেরা সংস্কৃতি ঢুকে গেছে সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে। দেশাত্মবোধক চেতনা আজ ধ্বংসের দোরগোড়ায়। এই চেতনার বিনির্মাণ ছাড়া আমাদের সামনের পথ একেবারেই রুদ্ধ।
প্রশ্ন হতে পারে তাহলে শিক্ষা কি কেবল চাকরি প্রাপ্তির জন্যই প্রয়োজন? না, চাকরি প্রাপ্তির জন্যই কেবল শিক্ষা লাগেনা। মূলত প্রয়োজন বিকশিত জাতি গঠনের জন্য। ছাত্র-শিক্ষক উভয়েরই এই নীতিতে অটল থাকতে হবে। জাতীয়-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিক চেতনাকে ধারণ করে সমাজকে এগিয়ে নেয়া সকলের দায়িত্ব। যে দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি আজ ম্রিয়মাণ, তাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। সংস্কৃতি যেহেতু রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়। সংস্কৃতির কথা এলে প্রথমেই বলতে হয় রাজনীতির কথা। তাই সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনতে গেলে রাজনৈতিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। আমূল রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া শিক্ষার বিকাশ কখনো সম্ভব নয়। এই লক্ষ্যে সংগ্রামকে বেগবান করা আজ একান্ত প্রয়োজন।

Comments

Popular posts from this blog

অভিজ্ঞতাবাদ

সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য