বিপ্লবী গণতন্ত্র সম্পর্কে
১৮৮২ সালের ২৬ জুন, বার্নস্টেইনকে লেখা এক চিঠিতে এঙ্গেলস উল্লেখ করেন, “আয়ারল্যান্ডের আন্দোলনে দুটি প্রবণতা লক্ষ্যণীয় – বিপ্লবী কৃষি আন্দোলন, যা কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে এবং তার রাজনৈতিক অভিব্যক্তি হলো বিপ্লবী গণতন্ত্র; অপরদিকে রয়েছে – জাতীয় উদারনৈতিক শহুরে বুর্জোয়ারা। এটি কৃষক আন্দোলনে সবসময়ের ক্ষেত্রেই সত্য। এই আন্দোলন তখনই সফল হতে পারে, যখন তা শহুরে কেন্দ্রগুলোতে নেতৃত্ব খুঁজে পাবে। বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে, তা হতে পারে বুর্জোয়া নেতৃত্ব,
অথবা সর্বহারা নেতৃত্ব। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে যে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বারা জাতীয় মুক্তির মতো কোনো মৌলিক সমস্যার সমাধান করতে বুর্জোয়ারা অকার্যকর – আয়ারল্যান্ড যার অন্যতম উদাহরণ।” অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে এঙ্গেলস বুর্জোয়া গণতন্ত্র থেকে ভিন্ন এক বিপ্লবী গণতন্ত্রের বিষয়টি তুলে ধরেছেন, যে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিবে সর্বহারাশ্রেণী। পরবর্তীতে, কমরেড মাও সে–তুঙ যাকে নয়া–গণতন্ত্র বলে তত্ত্বায়ন করেছেন।
ঔপনিবেশিকতা থেকে জাতীয় মুক্তিতে সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্ব সম্পর্কে ১৮৮২ সালে এঙ্গেলস কাউটস্কির নিকট এক চিঠিতে লিখেন, “স্থানীয় অধিবাসীরাই বসবাস করে এমন সব দখলীকৃত দেশ – ভারত,
আলজেরিয়া, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ ও স্পেনিয় অধিকৃত দেশগুলো – এদের ভার সাময়িকভাবে সর্বহারাশ্রেণীকে নিতে হবে এবং যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যেতে হবে। এ প্রক্রিয়া ঠিক কিভাবে বিকাশ লাভ করবে তা বলাটা মুশকিল। ভারতে হয়তো, প্রকৃতপক্ষেই যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে,
বিপ্লব করবে এবং নিজের মুক্তির প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত শ্রেণী হিসেবে সর্বহারাশ্রেণী যেহেতু কোনো ঔপনিবেশিক যুদ্ধ করতে পারে না,
তাই সেই বিপ্লবকে তার নিজ পথে চলতে দিতে হবে। সব ধরনের ধ্বংস ছাড়া তা এগোতে পারে না। একই কথা আলজেরিয়া বা মিশরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সেটাই হবে নিশ্চিতভাবে আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো বিষয়।”
পুঁজিবাদ, তথা সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন–
কবলিত ঔপনিবেশিক, আধা–ঔপনিবেশিক বা নয়া–ঔপনিবেশিক দেশসমূহে এই সর্বহারা বিপ্লব দুটি পর্বে বিভক্ত – নয়া–গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। প্রথম পর্ব হলো – ঔপনিবেশিক / আধা–ঔপনিবেশিক
/ নয়া–ঔপনিবেশিক ও ফ্যাসিবাদী শোষণ থেকে মুক্ত স্বাধীন ও নয়া–গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন; আর দ্বিতীয় পর্ব হলো – এই বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তর। এই সংগ্রাম পরিচালিত হয় সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্বে অন্যান্য মেহনতি শ্রেণীসমূহের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব – নয়া–গণতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে পরিচালিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। যা সাম্যবাদের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক উৎক্রমণেরই একটি ধাপ; তার থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
মাও সে–তুঙ বলেন, “যদিও প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ এবং অক্টোবর বিপ্লবের পরে কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতির কারণে (গ্রিক আগ্রাসনকে হটিয়ে দেওয়াতে বুর্জোয়ার সাফল্য এবং সর্বহারার দুর্বলতা) কামালপন্থী বুর্জোয়া একনায়কত্বের উদ্ভব তুরস্কে ঘটেছিল;
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যের সাফল্যের পর আর কোনো দ্বিতীয় তুরস্ক হতে পারে না, ৪৫ কোটি অধিবাসীর দেশে তো নয়ই। চীনের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে (মিটমাটের ঝোঁকসম্পন্ন বুর্জোয়ার নড়বড়ে অবস্থা এবং বিপ্লবী একাগ্রতা–সম্পন্ন সর্বহারার শক্তি), ব্যাপারটা তুরস্কের মতো সহজ কখনোই হয়নি। ১৯২৭ সালে প্রথম মহান বিপ্লব ব্যর্থ হবার পর চীনা বুর্জোয়াশ্রেণীর কিছু সদস্য কি কামালপন্থার গাওনা গায়নি? কিন্তু চীনের কামাল কোথায়?
আর চীনের বুর্জোয়া একনায়কত্ব এবং পুঁজিবাদী সমাজই বা কোথায়? এ প্রসঙ্গে এটাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, কামালের তুরস্ককেও শেষ পর্যন্ত ইঙ্গ–ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের কোলে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছিল, আর এভাবে তুরস্ক ক্রমান্বয়ে এক আধা–উপনিবেশ এবং প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার অংশে পরিণত হয়েছিল। আজকের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে, উপনিবেশ এবং আধা–
উপনিবেশের এইসব “বীর”–দের হয় সাম্রাজ্যবাদী ফ্রন্টে দাঁড়িয়ে নিজেকে বিশ্ব–
প্রতিবিপ্লবী শক্তির অংশে পরিণত করতে হবে,
না হয় সাম্রাজ্যবাদ–বিরোধী ফ্রন্টে দাঁড়িয়ে নিজেকে বিশ্ববিপ্লবের শক্তিগুলির অংশে পরিণত করতে হবে। তাদের এদুটির যে কোনো একটিকে বাছতেই হবে, কারণ তৃতীয় কোনো রাস্তা নেই।” (নয়া–গণতন্ত্র সম্পর্কে)
১৯৪০ সালের জানুয়ারিতে মাও তত্ত্বায়ন করেন নয়া–গণতন্ত্রের থিসিস। এই ঐতিহাসিক রচনায় কমিউনিস্ট আন্দোলনে কিছু মৌলিক সংযোজন এসেছিল, যা ছিল পরিবর্তিত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের দাবি। এর আগে পর্যন্ত জাতীয় প্রশ্ন বা জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে প্রধানত বুর্জোয়াদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অংশ হিসেবেই দেখা হতো। কিন্তু এই থিসিসে বলা হয় – ঔপনিবেশিক, আধা–ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে, যেখানে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের পর বুর্জোয়াশ্রেণীর একটা অংশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে, আর অপর অংশটি জাতীয় প্রশ্নে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম নয়, সেখানে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দায়িত্বটিকেও সর্বহারাশ্রেণীকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে। সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্বে এই বিপ্লবের মিত্রশক্তি হলো – মাঝারি ও ভূমিহীন কৃষক,
শহুরে মধ্যশ্রেণীসহ ব্যাপক নিপীড়িত শ্রেণীসমূহ। শত্রুশ্রেণী হলো বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল শ্রেণীসমূহ। এই গণতন্ত্র হবে বুর্জোয়া গণতন্ত্র থেকে পৃথক – তার রাজনীতি, অর্থনীতি,
সংস্কৃতিও হবে বুর্জোয়া চেতনা থেকে পৃথক। বুর্জোয়া গণতন্ত্র যেমন আদতে বুর্জোয়াশ্রেণীর একনায়কত্ব, তেমনি এই বিপ্লবী গণতন্ত্র হলো সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্বে ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব। এই বিপ্লবী গণতন্ত্রকে নামকরণ করা হয় – নয়া–গণতন্ত্র। আর এই নয়া–গণতন্ত্র সাম্যবাদের পথে বিপ্লবী অভিযাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তাকে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদে যাওয়ার পূর্ববর্তী ধাপ হিসেবে তত্ত্বায়ন করা হয় এই থিসিসে।
থিসিসে উদ্ধৃতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়, “জাতীয় সমস্যার মূল বিষয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এখন আর সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ নয়, তা এখন সাধারণ সর্বহারা, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবেরই অংশে পরিণত হয়েছে…” (আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আলোচনার সারসংকলন, ১৯১৬ – লেনিন)। ১৯১৮ সালে অক্টোবর বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকীতে এক প্রবন্ধে স্ট্যালিন বলেন, “এই বিপ্লব (অক্টোবর বিপ্লব) জাতীয় সমস্যার পরিধিকে বিস্তৃত করে দিয়েছে – তাকে ইউরোপে জাতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে আংশিক সমস্যা হতে রূপান্তরিত করেছে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে নিপীড়িত জাতিসমূহ, উপনিবেশ ও আধা–
উপনিবেশগুলোর মুক্তির সাধারণ সমস্যায়…।”
লেনিন বলেন, “জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য গণতন্ত্র এবং জনগণের শোষক ও নিপীড়কদের বল–প্রয়োগে দমন,
অর্থাৎ গণতন্ত্র থেকে বহিস্কার – গণতন্ত্রের এই রূপান্তরই ঘটে পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উৎক্রমণের সময়।”
বর্তমান বিশ্ব–প্রেক্ষাপটে বুর্জোয়া নেতৃত্বাধীন কোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদের নাগপাশ থেকে নিপীড়িত জাতিসত্তা ও জনগণকে মুক্ত করতে পারে না। কারণ তারা নিজেরাই সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা আবদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বব্যাপী শোষক–
ব্যবস্থা কায়েম করার মাধ্যমে তার শোষণ প্রক্রিয়াকে যেমন তীব্রতর করে, তেমনি সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশগুলোকেও নতুন পন্থায় উপনিবেশে পরিণত করে; যার নাম – নয়া–
উপনিবেশবাদ; যেখানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এক দালাল–বুর্জোয়াশ্রেণীর বিকাশ ঘটায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণী দুর্বল অবস্থায় বিদ্যমান। এর ফলে সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট দালাল–
বুর্জোয়াশ্রেণীই এসময়ের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারক–বাহকে পরিণত হয়। আর এজন্যই এসময়ে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্বও দিতে হবে সর্বহারাশ্রেণীকে।
নয়া–গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে কমরেড মাও আরো বলেন, “জনগণের রাষ্ট্র জনগণকে রক্ষা করে। শুধু জনগণের রাষ্ট্র থাকলেই জনগণ সারা দেশব্যাপী ও সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দ্বারা নিজেদেরকে শিক্ষিত ও পুনর্গঠিত করতে পারবেন, স্বদেশি ও বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রভাব (যা এখনো খুবই জোরদার, যা দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান থাকবে এবং যাকে দ্রুত বিনাশ করা যায় না) থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবেন, পুরোনো সমাজ থেকে প্রাপ্ত বদভ্যাস ও খারাপ মতাদর্শ দূর করতে পারবেন,
প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা নিজেদেরকে বিপথে চালিত হতে দেবেন না এবং অব্যাহতভাবে অগ্রসর হতে থাকবেন – অগ্রসর হতে থাকবেন সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট সমাজের দিকে।” (নয়া–গণতন্ত্র সম্পর্কে)
বুর্জোয়া গণতন্ত্র, নয়া–গণতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র ও পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের মাঝে আমাদের সুস্পষ্ট পার্থক্য রেখা টানতে জানতে হবে। বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্র সমাজে বিভাজনকে টিকিয়ে রেখে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানে একটা আপাত সমতাকে তুলে ধরে, যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ক্ষমতাসীন থাকে বুর্জোয়াশ্রেণীর একনায়কত্ব। অপরদিকে,
নয়া–গণতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্বে কৃষক, মধ্যশ্রেণী সহ অন্যান্য উৎপাদক শ্রেণীসমূহের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব। আর সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীন থাকে সর্বহারাশ্রেণীর গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব, যার লক্ষ্য থাকে উপরের সমতাকে নিচুতলা পর্যন্ত প্রসারিত করা ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে সেই সমতার প্রতিনিধিত্বমূলক করে তোলা। অর্থাৎ,
পুঁজিবাদ যেখানে উৎপাদনের সামাজিকীকরণ করে, কিন্তু উৎপাদনের উপায়সমূহের মালিকানা থাকে বুর্জোয়াশ্রেণীর হাতে; সেখানে সমাজতন্ত্রে উৎপাদনের উপায়সমূহও সামাজিকীকরণ করা হয়। অপরদিকে,
কেবলমাত্র সাম্যবাদী শ্রেণীহীন সমাজেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে পরিপূর্ণ গণতন্ত্র – যেখানে রাষ্ট্র কার্যকর থাকে না।
চীন বিপ্লবের উদাহরণ এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সেখানে নয়া–গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর জাতীয় বুর্জোয়াদের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে পাঠানো হয় এবং পুঁজিবাদকে সামগ্রিকভাবে উৎখাতের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বুর্জোয়ারা সমাজতন্ত্রের পথে যেতে বাধ্য হয়েছিল এবং সমাজতন্ত্র মেনে নেওয়ার শর্তে তাদের গণতান্ত্রিক সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এমনকি,
সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণকালেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় শ্রমিক–কৃষক ছাড়াও পেটিবুর্জোয়া এবং জাতীয় বুর্জোয়াদেরও অংশ ছিল। এই গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব জাতীয় গণতান্ত্রিক চরিত্রের নয়; বরং তা ছিল সমাজতান্ত্রিক চরিত্রের। আর সর্বহারাশ্রেণীর একনায়কত্ব শক্তিশালী হওয়ার কারণেই জনগণের এরূপ গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করা সম্ভব হয়েছিল।
রাশিয়াতেও অক্টোবর বিপ্লব–পরবর্তী সময়কালে অনুরূপ উদাহরণ রয়েছে। সেখানকার গণতান্ত্রিক দলগুলো ছিল, মূলত বুর্জোয়া–পেটিবুর্জোয়া চরিত্রের। তারা সমাজতন্ত্র মেনে নেওয়ার শর্তে গণতন্ত্র ভোগ করতো, তেমনি জাতীয়–পেটিবুর্জোয়ারাও ভোগ করতো। বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে মেনশেভিক ও বামপন্থী সোস্যালিস্ট রেভল্যুশনারিদের বলশেভিকদের সঙ্গে সরকারে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ১৯১৮ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত সোস্যাল রেভল্যুশনারি পার্টি রাষ্ট্রক্ষমতায় ক্ষমতাসীন ছিল।
মেনশেভিক বা বামপন্থী সোস্যালিস্ট রেভল্যুশনারি দলগুলো নিজেদের সমাজতান্ত্রিক ও সর্বহারাশ্রেণীর দল বলে প্রচার করলেও, মূলত তারা ছিল পেটিবুর্জোয়াদের সংগঠন। কিন্তু সমাজতন্ত্রকে, বলশেভিক বিপ্লব ও বলশেভিক নেতৃত্বকে মেনে নেওয়ার শর্তে লেনিন তাদেরকে গণতান্ত্রিক সুযোগ দিয়েছিলেন এবং সরকারেও ক্ষমতার অংশ তাদেরকে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তারা ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চালালে তাদের নিষিদ্ধ করা হয়। তখন আর গণতান্ত্রিক সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এরপর তারা সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণ প্রক্রিয়া নস্যাৎ করতে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছিল। রুশ বিপ্লবের এই পর্যায়টি ছিল মূলত নয়া–গণতান্ত্রিক ধাঁচের,
যেখানে কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়,
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয় – যা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে ভিন্নতর; কিন্তু তা ছিল সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণ প্রক্রিয়ার অন্তর্গত এবং অপরিহার্য। তৎকালীন রাশিয়ার আর্থ–সামাজিক অবস্থার কারণেই এমন বাস্তবতা তৈরী হয়েছিল। এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।
সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্বের মীমাংসা করার ক্ষেত্রে মাও সে–তুঙ বলেন, “জনগণের মধ্যে ভুল ভাবধারার ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। এই সমস্ত চিন্তা নিষিদ্ধ করে তার প্রকাশের কোনো সুযোগ না দেওয়া ঠিক হবে কি? নিশ্চয়ই নয়। জনগণের মধ্যকার মতাদর্শগত প্রশ্নের সমাধানের ক্ষেত্রে, মানুষের চিন্তাজগতের প্রশ্ন সমাধানের ক্ষেত্রে স্থূল পদ্ধতির প্রয়োগ শুধু নিষ্ফল নয়, রীতিমত ক্ষতিকর। ভুল মতের প্রকাশ নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, কিন্তু সেই ভাবধারা থেকেই যাবে।” (জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসা)
একই রচনায় তিনি আরো বলেন, “শতফুল ফুটতে দেওয়া আর শত রকমের মতবাদকে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে দেওয়ার নীতি – শিল্পকলার বিকাশ এবং বিজ্ঞানের প্রগতির পথ খুলে দেওয়ার কর্মনীতি এবং আমাদের দেশে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর কর্মনীতি। শিল্পকলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপ আর শৈলীর স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করা উচিত এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতবাদের স্বাধীনভাবে প্রতিযোগিতা করা উচিত। আমরা মনে করি, একটা বিশেষ শিল্পশৈলী বা মতবাদকে চাপিয়ে দেওয়ার এবং অন্য শৈলী বা মতবাদকে নিষিদ্ধ করার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে তা শিল্পকলা আর বিজ্ঞানের বিকাশের পক্ষে ক্ষতিকর হবে।”
এখানে শিল্পকলা বা বৈজ্ঞানিক বিকাশকে শ্রেণী–দৃষ্টিভঙ্গীর বাইরে থেকে দেখা হয়নি। বরং জনগণের মাঝে শ্রেণী অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় এবং সংগঠিত করার জন্যই এই কথাটি বলা হয়েছে। জনগণের মধ্যকার ভুল চিন্তাকে নিষিদ্ধ করলেও তা থেকে যাবে। তা নিষিদ্ধ করলে বরং জনগণের একাংশ সেই পরিত্যক্ত আবর্জনাকেই লোভনীয় কিছু বলে মনে করতে পারে। আর তাতে জনগণের মাঝে বিভক্তি আর অবিশ্বাসের বীজই কেবল বপন করা হবে। বরং জনগণ যখন নিজে থেকেই সঠিক আর ভুলের পার্থক্য নির্দেশ করবে;
তখন জনগণের মাঝে সর্বহারাশ্রেণীর ভিত্তিটিই আরো মজবুত হবে। জনগণের মধ্যে এই গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে অবশ্যই তারা সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি থেকে, আর পার্টি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
মাও জনগণের মধ্যকার এই গণতন্ত্রের বিষয়টা শুধু তাদের ঐক্যবদ্ধ রাখার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখেননি, বরং তার চেয়েও বেশি করে দুটো বিষয় ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি হচ্ছে জনগণের মতাদর্শগত পুনর্গঠনের প্রশ্ন এবং অপরটি হচ্ছে সঠিকতা বা সত্য গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া ও তা নির্ধারণের উপায় সংক্রান্ত প্রশ্ন।
সর্বহারা একনায়কত্বের দুটো দিক – একটা হলো, তা সমাজতন্ত্রের শত্রুদের উপর একনায়কত্ব প্রয়োগ করে; অন্যটা হলো, তা সমাজতন্ত্রের পক্ষের ব্যাপক জনগণের জন্য গণতন্ত্র (সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র) নিশ্চিত করে। এই যে জনগণ সমাজতন্ত্রের পক্ষে, তারা কিন্তু বিভিন্ন ধরনের মতাদর্শে সজ্জিত। তারা অগ্রসর, মাঝারি, পশ্চাদপদে বিভক্ত। মার্ক্সবাদ সম্বন্ধে তাদের ধারণা একেক ধরনের, মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে তারা একেক মাত্রায় ধারণ করে এবং একেক মাত্রায় আয়ত্ত করে। সমাজতন্ত্রকেও তারা একেক মাত্রার মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সহকারে দেখে। সুতরাং এই জনগণের মধ্যে মতাদর্শগত ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে, আর পার্থক্য থাকলে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। উপরিকাঠামোর অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিল্প–
সংস্কৃতি–বিজ্ঞানেও এই বিভিন্ন মত প্রকাশ পেতে বাধ্য। সেখানেও দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী।
শুধুমাত্র শিল্পকলা বা পদ্ধতিগত প্রশ্নের মতপার্থক্য আকারেই নয়, সমগ্র সমাজতান্ত্রিক পর্যায়কাল জুড়ে এই দ্বন্দ্ব শ্রেণী সংগ্রাম আকারেও থেকে যাবে, মার্ক্সীয় ধারণা ও অমার্ক্সীয় ধারণা আকারেও তা থেকে যাবে। জনগণের মধ্যে এর সমাধান সম্ভব শুধুমাত্র সমালোচনা–আত্মসমালোচনা, আলোচনা–
বিতর্ক–পর্যালোচনা প্রভৃতির মাধ্যমেই। এবং একমাত্র এভাবেই সম্ভব জনগণের মতাদর্শগত পুনর্গঠন ঘটানো, তাদেরকে ক্রমাগতভাবে বেশি বেশি সংখ্যায় ও বেশি বেশি করে মার্ক্সবাদে টেনে আনা, সমাজতন্ত্রে তাদের সাধারণ স্বীকৃতি ও সাধারণ সমর্থনকে মার্ক্সবাদের প্রতি তাদের সঠিক উপলব্ধি ও আস্থায় পরিণত করা সম্ভব।
সর্বহারাশ্রেণীর একনায়কত্ব যদি জনগণের মতাদর্শগত পুনর্গঠনের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে, তাহলে বুর্জোয়াদের উপর একনায়কত্ব প্রয়োগ করা হবে অর্থহীন। জনগণের মধ্য থেকেই অতিদ্রুত অসংখ্য নব্য–বুর্জোয়ার উদ্ভব ঘটতে থাকবে এবং কমিউনিস্ট পার্টি তার উপর ন্যস্ত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে। সর্বহারাশ্রেণীর নিজেকে এবং সমগ্র মানব জাতিকে মুক্ত করার কথা সেক্ষেত্রে কেবল পুস্তকেই থেকে যাবে।
এই বিষয়টির সঙ্গেই জড়িত আরেকটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো – মার্ক্সবাদ, তথা সঠিকতা ও সত্যের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ সাধনের প্রশ্ন। বাস্তবে জনগণের মধ্যকার ভুল মতাদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমেও সত্যটা বিকশিত হবে। মার্ক্সবাদ শুধু তার বৈরী শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমেই যে বিকশিত হয় তা নয়, বরং জনগণের মধ্যকার অবৈরী কিন্তু অমার্ক্সীয়, অবৈজ্ঞানিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেও তা বিকশিত হবে। এ প্রসঙ্গে মাও বলেন,
“ যদি নির্ভুল ভাবধারাগুলোকে চারা গাছের মতো উষ্ণ ঘরে আদর–যত্নে রেখে দেওয়া হয়,
যদি সেগুলো কখনো ঝড়–ঝাপ্টার সম্মুখীন না হয় এবং রোগ প্রতিশেধক শক্তি না পায়;
তাহলে ভ্রান্তমতের বিরুদ্ধে সেগুলো জয়লাভ করতে পারবে না। সতরাং, একমাত্র আলোচনা–সমালোচনা আর যুক্তি দিয়ে বলার পদ্ধতি অবলম্বন করেই আমরা নির্ভুল মতকে বিকশিত করতে পারি, ভ্রান্তমতকে হারাতে পারি এবং বিভিন্ন প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারি।”
জনগণের মধ্যে ‘গণতন্ত্র’ প্রয়োগ করেই প্রতিক্রিয়াশীলদেরকে, জনগণের শত্রুদেরকে জনগণ থেকে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, প্রতিক্রিয়াশীলরা নিজেদেরকে বেশিদিন আড়াল করতে সক্ষম হতে পারে না। জনগণের মধ্যকার গণতন্ত্রের সুযোগে তাদের প্রতিক্রিয়াশীলতাও দ্রুতই জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়তে বাধ্য;
আর জনগণ তাদেরকে নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে আরও ভালোভাবে চিনতে ও সমূলে উৎখাত করতে সক্ষম হবে।।
Comments
Post a Comment